চায়না থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি করতে হলে কিছু নির্দিষ্ট আইন ও কর সম্পর্কিত নিয়ম মেনে চলতে হয়। এটি শুধুমাত্র একটি সহজ আমদানির প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে না, বরং এটি ব্যবসাকে সুরক্ষিত রাখে এবং ঝুঁকি হ্রাস করে। এই ব্লগে আমরা বাংলাদেশে চায়না থেকে পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় আইন এবং কর সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচনা করবো।
১. আমদানিকারকের জন্য প্রাথমিক নিবন্ধন
বাংলাদেশে পণ্য আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট কিছু লাইসেন্স এবং নিবন্ধন প্রয়োজন হয়:
-
ট্রেড লাইসেন্স
এটি স্থানীয় সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা থেকে নিতে হয়। ব্যবসার বৈধতা এবং পরিচালনার অনুমোদন হিসেবে ট্রেড লাইসেন্স গুরুত্বপূর্ণ। -
ইমপোর্টার রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (IRC)
আমদানির জন্য ইমপোর্টার রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (IRC) প্রয়োজন হয়, যা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন থেকে সংগ্রহ করা যায়। এই লাইসেন্সটি ব্যবসার ধরন অনুযায়ী ইস্যু করা হয়। -
ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN)
ব্যবসায়িক ট্যাক্স পরিশোধের জন্য একটি বৈধ TIN নম্বর আবশ্যক। -
ভ্যাট নিবন্ধন
যদি ব্যবসায় ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়, তবে ভ্যাট নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক। ভ্যাটের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) থেকে নিবন্ধন করতে হয়।
২. প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন এবং অনুমোদন
চায়না থেকে পণ্য আমদানির জন্য কিছু নির্দিষ্ট ডকুমেন্ট প্রয়োজন হয়। এগুলো কাস্টমস এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থার জন্য দরকার।
-
কমার্শিয়াল ইনভয়েস
ইনভয়েসে পণ্যের বিবরণ, মূল্য, পরিমাণ এবং অন্যান্য তথ্য সঠিকভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। -
প্যাকিং লিস্ট
পণ্যের প্যাকেজিং, পরিমাণ, ওজন এবং বিভিন্ন আইটেমের তালিকা প্যাকিং লিস্টে দেওয়া হয়। -
বিল অব লেডিং বা এয়ারওয়ে বিল
এটি শিপমেন্টের মালিকানা এবং পরিবহন পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য দেয়। এই ডকুমেন্টটি শিপিং কোম্পানি বা এয়ারলাইন্স দ্বারা ইস্যু করা হয়। -
সার্টিফিকেট অব অরিজিন
পণ্যের উৎস দেশ চিহ্নিত করতে এই ডকুমেন্ট প্রয়োজন হয়। এটি সাধারণত রপ্তানিকারক দেশের চেম্বার অব কমার্স থেকে ইস্যু করা হয়।
৩. কাস্টমস ফি এবং শুল্ক
চায়না থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির সময় কাস্টমস ডিউটি এবং শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। কাস্টমস ফি পণ্যের ধরন এবং ভ্যালুর ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে আমদানি শুল্ক নিম্নোক্ত মূল শুল্ক ফি অন্তর্ভুক্ত করে:
-
ইমপোর্ট ডিউটি
পণ্যভেদে আলাদা হতে পারে, সাধারণত শুল্ক হার ০%-২৫% পর্যন্ত হতে পারে। -
ভ্যাট (VAT)
পণ্য আমদানির ওপর প্রায় ১৫% ভ্যাট চার্জ প্রযোজ্য। -
অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (AIT)
পণ্যের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ এআইটি চার্জ করতে হয়, যা সাধারণত ৫%। -
অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট (ATV)
নির্দিষ্ট পণ্যের ক্ষেত্রে অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট চার্জ করা হয়, যা প্রায় ৩%। -
সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি
কিছু বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শুল্ক বা সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি প্রযোজ্য হতে পারে। যেমন বিলাসবহুল বা উচ্চমূল্যের পণ্য।
৪. আমদানি আইন এবং মান নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশে চায়না থেকে আমদানি করার সময় কিছু নির্দিষ্ট মান নিয়ন্ত্রণ এবং আমদানি আইন মেনে চলা জরুরি।
-
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI)
কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের মান নিয়ে BSTI এর অনুমোদন প্রয়োজন হয়। যেমন খাদ্য, প্রসাধনী, ওষুধ প্রভৃতি। -
পরিবেশ আইন
পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে এমন পণ্য আমদানির জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন। -
হেলথ সার্টিফিকেট
খাদ্যপণ্য বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সনদ প্রয়োজন হয়, যা পণ্যটি নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করে। -
বিশেষ অনুমোদন
কিছু বিশেষ পণ্য যেমন ক্যামিক্যাল, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ইত্যাদির জন্য আমদানি পূর্বে নির্দিষ্ট সরকারি অনুমোদন নিতে হয়।
৫. আইনি এবং আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলা
চায়না থেকে পণ্য আমদানির সময় অনেক আইনি এবং আর্থিক ঝুঁকি থাকে। তাই এসব ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত:
-
সঠিক ডকুমেন্টেশন
প্রতিটি ডকুমেন্ট যেন যথাযথ হয় তা নিশ্চিত করতে হবে, কারণ যেকোনো ভুলের কারণে পণ্য আটকে যেতে পারে বা অতিরিক্ত ফি দিতে হতে পারে। -
মান নিয়ন্ত্রণ এবং গুণগতমান নিশ্চিতকরণ
পণ্যের মান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন এবং প্রয়োজন হলে চেকিং এজেন্সির মাধ্যমে যাচাই করিয়ে নিন। -
পেমেন্ট টার্মস
পেমেন্ট টার্ম সম্পর্কে সরবরাহকারীর সাথে স্পষ্ট চুক্তি করা উচিত। এলসি (Letter of Credit) এর মাধ্যমে পেমেন্ট করলে ঝুঁকি কমে।
উপসংহার
বাংলাদেশে চায়না থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আইনি এবং কর সংক্রান্ত জটিলতা অনেকটাই নির্ভর করে সঠিক প্রস্তুতি এবং নিয়ম মেনে চলার ওপর। সঠিক ডকুমেন্টেশন, কর সম্পর্কিত নিয়ম মেনে চলা, এবং মান নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে চায়না থেকে আমদানির প্রক্রিয়া অনেক সহজ এবং ঝামেলামুক্ত হয়।